কিছু দিন আগেকার কথা । আমার এক বন্ধুর সাথে আমার ফোনে বেশ কিছুক্ষন কথা হয় । সিনেমা, গান, কবিতা, পড়াশুনা আর অবশই —“covid-19” নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার পর আমার সেই বন্ধু বললো —– “তুইও তো ব্লগ লিখতে পারিস । এখন বাড়িতে সারাটা দিন তো প্রায় শুয়ে বসেই কাটছে…. তারচেয়ে বরং একটু লেখা লেখি কর!”
(যদিও আমার সেই বন্ধু এতো ভালো ভাষা প্রয়োগ করেনি বললেই চলে, কিন্তু প্রথম ব্লগেই তো আর কাঁচা খিস্তি লেখা যায় না…. কাজেই নিজেদের মতন করে বুঝেনিন আমার সেই শুভাকাঙ্খী বন্ধু ঠিক কোন কোন জায়গায় কটু বাক্য ব্যবহার করেছে ।
যাই হোক…)
বেপারটা আমিও যে বিগত কয়েক মাস ধরে ভাবিনি তা নয়, কিন্তু নানা কারণে আর হয়ে ওঠেনি । শেষ পর্যন্ত আজ দুপুরবেলা আমার এই পেজটি সৃষ্টি করলাম এবং তার সঙ্গে – সঙ্গেই আমার মনের ভেতরটা কেমন যেন খচখচ করে উঠলো।
পেজ তো বানালাম, লিখবো কি?
প্রথমে ভাবলাম রাজনীতি নিয়ে লিখে বেশ একটা ছোটোখাটো ভার্চুয়াল বিপ্লব করে ফেলবো । কেন্দ্রীয় সরকার আর রাজ্য সরকারের একটা ছোটোখাটো ক্রিটিসিজম দিয়ে আমার এই যুগান্তকারী পেজ টির শুরু হোক! কিন্তু পরমুহূর্তেই বুঝলাম —না । সবাই যা করছে সেই একই জিনিস আবার নতুন মলাটে করে ছাপাবার কোনো মানে হয় না ।
তাহলে এখন উপায়? মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদ নিয়ে লিখবো? “কিশোরের চোখে মার্ক্সের দর্শন ” ।বেশ একটা নস্টালজিক টান ব্যবহার করে নক্সালবাড়ি, কিউবা, ভিয়েতনাম বা আমাদের গ্রেট সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে দু-কলম লিখলে কেমন হয়? তারপরেই নিজের লোভ সামলে নিলাম । এই বেপারে আরেকটু পড়াশুনা দরকার । নাহলে বেঘোরে কেস খেয়ে যাওয়ার সম্ভবনা আছে!
তাই শেষ পর্যন্ত ঠিক করি এই পেজটাকে রাখবো একেবারে যাকেবলে — transparent।
যা জানি তাই নিয়েই লিখবো । অযথা আঁতলামো মারার কোনো ইচ্ছা নেই ।
নিজের পেজের প্রথম বলির পাঠা… এই! থুড়ি… বিষয় অর্থাৎ টপিক হিসাবে বেছে নিলাম সিনেমাকে । সিনেমা নিয়ে যখন লিখবোই তখন আজ আমার খুবই কাছের একটা সিনেমা নিয়ে কিছু কথা বলবো । প্রথম বার দেখে মুগ্ধ তো হয়েছিলাম বটেই কিন্তু তারথেকেও বেশি যেটা অনুভব করেছিলাম সেটা হলো—-আমার সিনেমার প্রতি আপ্রাণ ভলোবাসা।
ছবির নাম?
চতুষ্কোণ।এই সিনেমার পরিচালককে অর্থাৎ সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে আমাদের ভারতীয় সিনেমার আলফ্রেড হিচকক বললে বোধহয় খুব ভুল হবে না । সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে আমরা চিনি একজন অতি নিখুঁত থ্রিলার পরিচালক হিসাবে । তার বানানো চলচ্চিত্র “বাইশে শ্রাবন”, “হেমলক সোসাইটি “, “রাজকাহিনী “,”নির্বাক” ইত্যাদি আমাদের বার বার মুগ্ধ করেছে । নতুন প্রজন্ম কে হলমুখী করার পেছনে বোধহয় অঞ্জন দত্তর নামের পরেই থাকবে সৃজিতের নাম । এখন পাঠকদের মধ্যে থেকে প্রশ্ন ওঠা টা স্বাভাবিক যে হঠাৎ করে এতো বছর আগের মুক্তিপ্রাপ্ত একটি সিনেমা নিয়ে এখন এতো দিন পরে কেন লিখছি । উত্তরটা খুবই সোজা —-এতদিন ব্লগ চ্যানেল ছিল না তাই লিখিনি! এইটাই তো স্বাভাবিক, তাই নয় কি?
যাই হোক । ভাটের কথাগুলি ভারতীয় অর্থনীতির ন্যায় কোনো পাত্তা না দিয়ে চলুন কথা বলি এই অসামান্য সিনেমাটির ব্যাপারে । চারজন পরিচালক – শাক্য, দীপ্ত, তৃনা এবং জয় চলেছে একজন প্রযোজকের বাড়িতে তার সাথে গিয়ে দেখা করার জন্য । অনুরোধটা জয়েরই । সেই নাম না জানা প্রযোজক নাকি চায় এই চারজন পরিচালক তাঁদের নিজেদের মতো করে চারটি শর্ট -ফিল্ম তৈরী করুক এবং সেটা নাকি একসাথে একটি “anthology ” film হিসাবে রিলিজ করার কথা ভাবা হবে । তবে প্রযোজকের শর্ত একটাই — এই চারটি শর্ট – ফিল্ম-এর একটি কমন থিম থাকতে হবে—–মৃত্যু ।গল্প নিয়ে আরও গভীরে বলতে পারতাম কিন্তু তার কোনো প্রয়োজন দেখছি না । এই সিনেমার পরিচালনা কতটা ভালো সেটা হয়তো আমি লেখার মাধ্যমে আপনাদেরকে বোঝাতে পারবো না । এবং আমি বোঝাতেও চাই না , কারন আমার মনে হয় এই সিনেমার ডাইরেকশন নিয়ে কথা বলার ম্যাচুরিটি আমার মধ্যে নেই ।
দুঃখিত ।
প্রথমে যদি অভিনয় নিয়ে কথা বলি তাহলে মানতেই হবে যে এই সিনেমাটিতে প্রত্যেকজন নিজেদের জায়গায় খুবই সুন্দর ভাবে কাজ করেছেন । চিরঞ্জিতকে কমার্শিয়াল ছবিতে দর্শকেরা দেখে অনেক হেসেছে এবং ওনাকে নিয়ে অনেক হাসাহাসি এখনো হয় । কিন্তু এই সিনেমাটিতে তিনি আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন যে উনি আসলে সত্যিই খুবই মেধাবী একজন অভিনেতা ।পরমব্রতর কথা আলাদা করে বলতেই হবে কারণ উনি এই সিনেমাটিতে নজরকাড়া কাজ করেছেন । ক্লাইম্যাক্স এর সিনে পরমব্রতর থেকে দৃষ্টি হটানো দায়!আমি এইখানে দুটি ক্যামিও নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই । কৌশিক গাঙ্গুলি এবং বরুন চন্দ এই সিনেমাতে খুবই ছোট দুটি রোলে আছেন । কিন্তু এইটুকু স্ক্রিন টাইমিং থাকা স্বত্বেও এরা দেখিয়ে দিয়ে গেলো —জাত অভিনেতা বলতে কি বোঝায় ।
এরপরে যদি কথা বলি এই সিনেমার আবহসংগীত নিয়ে তাহলে ঘন্টার পর ঘন্টা কেটে যাবে…. কিন্তু আমার কথা শেষ হবে না । বসন্ত এসে গেছে, বোবা টানেল, মনে পরার গান আমরা কতবারই না শুনেছি? বিশেষ করে এই সিনেমার ক্লাইম্যাক্স-এর দৃশ্যে ‘রাশিয়ান রুলেট’ খেলার জায়গায় আবহে বেজে ওঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘চিরসখা হে…… “।
চতুষ্কোণ সিনেমাটার যদি সব থেকে মজবুত পয়েন্ট নিয়ে কথা বলতে হয় তাহলে সেটি অবশ্যই এই সিনেমার অসাধারণ চিত্রগ্রহণ , যেটি করেছেন সুদীপ চ্যাটার্জী । সুদীপ চ্যাটার্জী বোম্বের ছবি তে কাজ করে থাকেন । ওনার কাজ আমরা পদ্মাবৎ, ইকবাল ইত্যাদি বইতে দেখেছি । অসম্ভব ভালো রকমের আলোর কাজ যা আমরা বাংলা সিনেমাতে দেখে অভ্যস্ত নই, ঠিক সেই রকমের বিশ্ব চলচ্চিত্র মানের আলোর কাজ এই ছবিতে দেখতে পাওয়া যায় । চতুষ্কোণ সিনেমাটির চিত্রগ্রহণ কে বোঝানোর সব থেকে সহজ উপায় হলো একটি ইংরেজি লাইন ব্যবহার করা
-‘every frame a painting’ । এর থেকে বেশি কিছু বলব না । এর পরে আমি কথা বলতে চাই এই সিনেমার চিত্রনাট্য নিয়ে। সৃজিত মুখোপাধ্যায়কে আমরা চিনি একজন অতি ভালো ডায়ালগ রাইটার হিসাবে । তার বাইশে শ্রাবন-এর ‘ডাল -ভাত আর বিরিয়ানি’ বা হেমলক সোসাইটির বিখ্যাত ডায়লগ ‘মরবে মরো ছড়িয় না’ এখন কার প্রজন্মের ছেলে মেয়েদের দৈন্যন্দিন ভোকাবুলারির অন্তর্গত । কিন্তু চতুষ্কোণে কোট-আনকোট কোনো দারুন ‘punchline’ নেই বললেই চলে । এই সিনেমাজুড়ে রয়েছে প্রচুর পপ-কালচার রেফারেন্স । রয়েছে পুরাকালের বাংলা সিনেমাকে ট্রিবিউট এবং কিছু হালকা খিল্লি! ডায়ালগ গুলো অনেকটা কোয়েন্টিন টারান্টিনোর কায়দায় লেখা হয়েছে । এই স্ক্রিপ্টটার স্ট্রাকচারটি হচ্ছে একোবারে নন – লিনিয়ার ধাঁচের । অধিকাংশ ক্ষেত্রেই একটা সিন থেকে অন্য সিন-এ ‘transition’ হচ্ছে ফ্ল্যাশব্যাক-এর মাধ্যমে ।
এই সিনেমাটার একটি অতি প্রশংসনীয় বিষয় হলো সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের কিছু ‘direction choice’ । অন্য কোনো পরিচালক যদি এই সিনেমাটি বানাতেন তাহলে তারা নিজেদের মতন করে এই চার জন পরিচালকদের শর্ট -ফিল্ম গুলি পর্দায় তুলে ধরতেন ঠিকই কিন্তু তারা কি এই ভিন্ন কালোর স্কিম ব্যবহার করতেন? আমার তো মনে হয় না ।
গৌতম ঘোষের অর্থাৎ শাক্যর শর্টফিল্মটি তোলা হয়েছে সবুজ কালার স্কিম-এ, চিরঞ্জিতের অর্থাৎ দীপ্তরটি তোলা লাল স্কিম-এ, অপর্ণা সেনের অর্থাৎ তৃনার শর্টফিল্মটি নেওয়া হয়েছে নীল রঙে এবং সব শেষে পরমব্রতর অর্থাৎ জয়েরটি নেওয়া হয়েছে ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট স্টাইল-এ । এই সিনেমাটির শেষে আসে একটি অভাবনীয় টুইস্ট যাকে এখন অনেকে বলে ‘সৃজিতিও মোড়’ ।
বাংলা তথা বিশ্ব-চালাচ্চিত্রকে মন প্রাণ দিয়ে ভালোবাসলেই বোধহয় এইরকম একটা অসামান্য সিনেমা গড়ে তোলা সম্ভব ।
কয়েকদিন আগে একটি অনলাইন পেজে পড়ছিলাম যে চিরঞ্জিতের চরিত্রটি করার কথা ছিল অঞ্জন দত্তের এবং পরমব্রতর জায়গায় পাঠ করার কথা ছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের ।কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আর হয়ে ওঠে না…
একটা কথা আছে না – যা কিছু হয়, তা ভালোর জন্যই হয়!